,

নবীগঞ্জে রুমি ও মালা হত্যাকান্ড ॥ আদালতে ঘাতকদের স্বীকারোক্তি, প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে এই হত্যাকান্ড ঘটায় ঘাতক তালেব ও শুভ

আনোয়ার হোসেন মিঠু/মতিউর রহমান মুন্না ॥ নবীগঞ্জ উপজেলার কুর্শি ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামে লন্ডন প্রবাসীর মা মালা বেগম ও তার স্ত্রী রুমি বেগমকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত দুই হত্যাকারী আদালতে লোমহর্ষক এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সম্পা জাহানের আদালতে এই স্বীকারোক্তি দেয় গ্রেফতারকৃত আসামী তালেব মিয়া এবং জাকারিয়া আহমেদ শুভ। স্বীকারোক্তিতে তারা জানায় লন্ডন প্রবাসীর স্ত্রী রুমি বেগমকে ধর্ষণ করতে গিয়ে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। অপর দিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রবাসীর স্ত্রী রুমীকে ধর্ষণ করাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। রুমী বেগমের স্বামী লন্ডনে থাকেন। প্রায় ২ বছর পূর্বে একই গ্রামের আখলাক চৌধুরী ওরপে গুলজারের সাথে তার বিয়ে হয়েছে।

Murder News File Pic

পুরুষ শূণ্য বাড়িতে শুধু রুমী বেগম এবং তার শ্বাশুড়ি মালা বেগম থাকতেন। ছয় কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটির কোনো সীমানায় দেয়াল ছিল না এবং আশ-পাশে কোনো প্রতিবেশীর ঘরও নেই। কয়েকদিন পূর্বে লন্ডন প্রবাসী আখলাক চৌধুরী তার এক বন্ধু রিপনকে তার স্ত্রী রুমী বেগমকে একটি মোবাইলের কাভার কিনে দিতে বলেন। রিপন ব্যস্ত থাকায় গত ১১ মে তার ভাই জয়কে দিয়ে এই কাভার রুমি বেগমের বাড়িতে পাঠায়। জয় মোবাইল কাভার নিয়ে যাওয়ার সময় ওই এলাকার জাকারিয়া রহমান শুভ নামে বখাটে যুবককে সাথে নিয়ে রুমিদের বাড়িতে যায়। জয় মোবাইল কাভারটি রুমি বেগমকে দিলে সেটি তার পছন্দ না হওয়ায় ফেরত দেয়। এ সময় প্রবাসীর স্ত্রী রুমি বেগমকে দেখে শুভ তার উপর কূ-দৃষ্টি দেয় এবং ধর্ষণের পরিকল্পনা করে। শুভ জানতে পারে রুমি বেগমদের বাড়িতে অপরিচিত কেউ গেলে গেইট খুলে দেয়া হয় না। শুভ খুঁজতে থাকে কোন পরিচিত লোক ওই বাড়িতে বেশি আশা যাওয়া আসা করে। অবশেষে সন্ধান পায় পাশের বাড়ির ফুরুক চৌধুরীর কর্মরত শ্রমিক তালেব মিয়া প্রায়ই ওই বাড়িতে গিয়ে কাজ করে। তাই ঘটনার আগের দিন গত শনিবার শুভ তালেব মিয়ার সাথে দেখা করে তাকে একটি দোকানে নিয়ে আপ্যায়ন করায় এবং মোবাইলে থাকা পর্নোগ্রাফী দেখায়। এরপর তারা পরিকল্পনা করে রবিবার (১৩ মে) রাতে গিয়ে লন্ডন প্রবাসীর স্ত্রী রুমি বেগমকে ধর্ষণ করবে। সে অনুযায়ী তারা রবিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ১০ টায় ওই বাড়িতে যায়, এবং যেহেতু তালেব পরিচিত তাই প্রথমে তালেব মিয়া প্রবাসীর মা মালা বেগমকে দাদী সম্বোধন করে ডাক দিয়ে গেইট খুলতে বলে। তার কথা অনুযায়ী গেইট খোলার পর তালেব মিয়ার সাথে শুভও ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় মালা বেগম ওই ছেলেকে দেখে তার পরিচয় জানতে চাইলে শুভ মালাকে হাতে থাকা ছোরা দিয়ে আঘাত করে। মালা বেগম দৌড়ে পাশের কক্ষে গেলে পিছু গিয়ে তারা দুইজন তাকে ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং ছোরা দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। তার শোর-চিৎকার শুনে পাশের কক্ষে থাকা গৃহবধূ রুমি বেগমও দৌড়ে এসে এসব দেখে চিৎকার শুরু করেন। এ সময় শুভ রুমি বেগমকেও ছোরা দিয়ে আঘাত করে। রুমি বেগম প্রাণ ভয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলে তালেব মিয়াও তার পিছু ধরে ঝাপটে ধরে মাটিতে ফেলে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করে। ঘটনার সময় ওই বাড়ির পাশে কুর্শি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমেদ মুছার বাড়িতে তার বিদেশ গমন উপলক্ষে একটি বৈঠক ছিল। সেখান থেকে লোকজন চিৎকার শুনে এসে রুমি বেগম ও মালা বেগমকে রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় দেখতে পান। পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা আরো জানান, নবীগঞ্জ উপজেলার আমতৈল গ্রামের আমীর হোসেনের পুত্র তালেব হোসেন (২৪) রুমি বেগমের গ্রামের বাড়ির লোক হওয়ায় সহজেই তাদের বাড়িতে আসা যাওয়ার সুযোগ নেয়। অপরদিকে জাকারিয়া রহমান শুভ (২০) পার্শ্ববর্তী বাহুবল উপজেলার খাগাউড়া গ্রামের হাফিজুর রহমানের পুত্র। সে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে এবং এলাকায় একজন বাখাটে প্রকৃতির লোক হিসবে পরিচিত। শুভ তার নানার বাড়িতে বসবাস করতো। তার পিতা অন্যত্র বিয়ে করে ছোটবেলা থেকেই শুভকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এই ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা এবং অবাধ পর্নোগ্রাফি সমাজে অপরাধ সৃষ্টি করে। এত বড় ঘটনার পর তালেব মিয়া এবং শুভ তাদের ব্যবহৃত ছোরা এবং রক্তমাখা কাপড় ধূয়ে স্বাভাবিকভাবে এলাকায় চলাফেরা করে। পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতারের পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রক্তমাখা কাপর এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছোরা উদ্ধার করে। এই ঘটনায় শুভ’র আরেক বন্ধু ধর্ষণে অংশ নেয়ার কথা ছিল। তাকেও খুঁজছে পুলিশ। তারপর দ্রুত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমে এই মামলার বিচার কাজ শুরু হবে। উল্লেখ্য, গত রবিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের হাতে নিজ বসত ঘরে খুন হন বউ-শাশুড়ী। নিহতরা হলেন নবীগঞ্জ উপজেলার কুর্শি ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী মৃত রাজা মিয়ার তৃতীয় স্ত্রী মালা বেগম এবং লন্ডন প্রবাসী পুত্র আখলাক চৌধুরী ওরফে গুলজারের স্ত্রী রুমি বেগম। সোমবার রাতে নিহত রুমি বেগমের ভাই ডাঃ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-১১। নবীগঞ্জ থানার ওসি তদন্ত হাবিবুর রহমানকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।


     এই বিভাগের আরো খবর